রাত তখন প্রায় বারোটা। গ্রামটি নিস্তব্ধ। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর মাঝে মাঝে বাতাসের ফিসফিসানি। চাঁদের আলোয় ভেসে থাকা গ্রামের মাটির পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে শুভ। তার চোখে আতঙ্ক, মুখে ঘামের রেখা। শুভ জানে, এই রাস্তায় কিছু আছে—কিছু যা মানুষ নয়।
গল্পটা শুরু হয়েছিল কয়েকদিন আগে। শুভ গ্রামের নতুন স্কুল শিক্ষক। শহর থেকে গ্রামে বদলি হয়ে আসার পর থেকেই কিছু একটা যেন তাকে অস্বস্তি দিচ্ছিল। গ্রামে প্রবেশের সময়ই সে একটি বড় বটগাছ দেখেছিল, যার নিচে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির। স্থানীয়দের কাছে জানতে চেয়েছিল, কিন্তু সবাই এড়িয়ে গিয়েছিল।
কেউ বলেছিল, “ওটা অভিশপ্ত জায়গা,” কেউ বলেছিল, “রাতে ওখানে যেও না।”
কৌতূহলী শুভ একদিন সন্ধ্যায় বটগাছের দিকে চলে গেল। গাছের তলায় পাথরের ভাঙা মূর্তি, আশেপাশে শুকনো পাতার স্তূপ। কিন্তু গাছটার সামনে দাঁড়াতেই এক অদ্ভুত শীতল অনুভূতি হলো তার। মনে হলো কেউ যেন তাকে দেখছে। আশেপাশে কেউ নেই, অথচ পায়ের কাছে পাতাগুলো নিজে থেকেই সরে যাচ্ছে। শুভ দ্রুত সেখান থেকে সরে আসে।
সেই রাতেই শুভর ঘরে অদ্ভুত ঘটনা শুরু হয়। প্রথমে হালকা আওয়াজ, তারপর জানালার বাইরে ছায়া। শুভ ভেবেছিল, এটা হয়তো তার মনের ভুল। কিন্তু পরদিন রাতে যখন সে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের বদলে এক অচেনা নারীর অবয়ব দেখে, তখন সে ভয় পেয়ে যায়।
গ্রামের এক প্রবীণ মানুষ, হরিদা, শুভকে বললেন, “তুই বটগাছের নিচে গেছিস না? ওখানে শত বছর আগে এক নারীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তার আত্মা আজও মুক্তি পায়নি। কেউ ওখানে গেলেই সে রাগে ফুঁসে ওঠে।” শুভ জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আমি কিছু করিনি। তাহলে কেন আমায় ভয় দেখাচ্ছে?”
হরিদা বললেন, “ও মুক্তি চায়। কিন্তু তুই যদি তার কথা না শুনিস, তোর সর্বনাশ হবে।”
পরের দিন রাতে শুভ সাহস করে মন্দিরে গেল। চাঁদের আলোয় গাছের নিচে দাঁড়িয়েই সে শুনল এক নারীর করুণ কণ্ঠ, “আমার মন্দির ভেঙে দিয়েছে ওরা। আমার আরাধনা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। আমি মুক্তি চাই। আমার মন্দির ফিরিয়ে দাও।”
শুভ তখন বুঝল, গ্রামের মানুষ এই আত্মাকে পরিত্যাগ করেছে। সে প্রতিজ্ঞা করল, মন্দির পুনর্নির্মাণ করবে।
গ্রামের লোকেরা প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেও, শুভর দৃঢ়তা দেখে তারা রাজি হয়। কয়েক মাসের চেষ্টায় মন্দির নতুন করে গড়ে ওঠে। মন্দির নির্মাণের শেষদিন রাতে শুভ আবার গাছের তলায় গেল। এইবার কণ্ঠটা ধন্যবাদ জানালো, “তোমার জন্য আমি মুক্তি পেয়েছি।”
তারপর থেকে বটগাছ আর মন্দির অভিশপ্ত নয়। গ্রামটা আবার শান্তি ফিরে পায়। কিন্তু শুভর জীবনে এই ঘটনা একটি অমলিন স্মৃতি হয়ে থেকে যায়।
শেষ।